বিশেষ প্রতিনিধি
বগুড়ার সোনাতলার রাণীরপাড়ার ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ ও সাবেক উপজেলা কমান্ডার রফিকুল ইসলাম সাতজনকে নিজের সন্তান সাজিয়ে তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সরকারি চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন। তাদের কাছ থেকে তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। দুদক বগুড়া জেলা কার্যালয়ের কর্মকর্তা তাকে প্রধান আসামি করে কথিত তিন ‘সন্তানের’ বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি মামলা করেছেন। প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় তিনজনকে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। শনিবার দুপুরে দুদক বগুড়া কার্যালয়ের উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম এর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
অভিযোগ ও খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম (৭২) বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার সদর ইউনিয়নের রাণীরপাড়া গ্রামের মৃত ফয়েজ উদ্দিন মন্ডলের ছেলে। তিনি সোনাতলা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার। রফিকুল ইসলাম ও রেবেকা সুলতানা দম্পতির দুই মেয়ে রাশেদা আকতার ও মোরশেদা আকতারের বিয়ে হয়েছে। রফিকুল ইসলাম মোটা অঙ্কের টাকার জন্য স্থানীয় কয়েকজনের সন্তানকে নিজের সন্তান দেখিয়ে তাদের মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি ও অন্যান্য সুবিধার ব্যবস্থা করেন। ইতোমধ্যে সাতজনের নাম পাওয়া গেলেও তিনি তার সনদপত্র ব্যবহার করে আরও অনেককে সরকারি চাকরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করেছেন বলে অভিযোগ আছে।
তার সাজানো সন্তানরা হলেন-সহোদর আহসান হাবিব ও জিয়াউর রহমান, বেলাল হোসেন, ফরহাদ হোসেন, সালেক উদ্দিন, রাকিব হাসান এবং মৌসুমী আকতার। হান্নান ও জিয়াউরের প্রকৃত বাবা সোনাতলার দক্ষিণ রাণীরপাড়ার জাফর আলী। এদের মধ্যে আহসান হাবিব মুক্তিযোদ্ধা সনদ ব্যবহার করে পুলিশে চাকরি পান। গাইবান্ধা পুলিশে রিজার্ভ ফোর্সে নায়েক পদে কর্মরত ছিলেন। মামলার পর তিনি সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন। জিয়াউর রহমানকে সারের ডিলারশিপসহ অন্যান্য সুযোগ দেন। উপজেলার রাণীরপাড়ার মৃত জবেদ আলীর ছেলে বেলাল হোসেন। তাকে ২০০১ সালে পুলিশে চাকরির ব্যবস্থা করা হয়। তিনি ডিএমপির ট্রাফিক জোনে এটিএসআই পদে কর্মরত ছিলেন। মামলার পর সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন। ফরহাদ হোসেন একই গ্রামের জাহিদুল ইসলামের ছেলে। তাকে ফায়ার সার্ভিসে চাকরির ব্যবস্থা করা হয়। মামলার পর তাকে গাইবান্ধার ফুলছড়ি ফায়ার সার্ভিস থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। একই গ্রামের নায়েব আলীর ছেলে সালেক উদ্দিন ২০০৫ সালে পুলিশ কনস্টেবল হন। পার্শ্ববর্তী জুমারবাড়ি এলাকার মোমিনুল ইসলামের ছেলে রাকিব হাসান চাকরি পেয়েছেন সমাজসেবা অধিদপ্তরে। তার ভাই শহিদুল ইসলামের মেয়ে মৌসুমী আকতারকে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজে ভর্তি করা হয়েছে।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি দুর্বল। এ সুযোগে রফিকুল ইসলাম বেশ কয়েকজনকে নিজের সন্তান সাজিয়ে কোটায় সরকারি চাকরি পেতে সহযোগিতা করেন। বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকাও হাতিয়ে নেন।
তিনি ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ সাইনবোর্ড সামনে রেখে নানা অপকর্মে জড়িত। তার অপকর্ম থামাতে সোনাতলা উপজেলার রাণীরপাড়ার কেল্লাগাড়ি গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন ও নিমেরপাড়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সাত্তার ২০২১ সালের ১৭ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর কাছে অভিযোগ দেন। দুজন বীর মুক্তিযোদ্ধা অভিযোগ করেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম একজন প্রতারক। তার এক স্ত্রী ও দুই মেয়ে রয়েছে। কোনো ছেলে নেই। অথচ তিনি ছেলে-মেয়ে মিলিয়ে সাতজনকে সন্তান সাজিয়ে তাদের কোটায় চাকরি পেতে সহায়তা করেছেন। অভিযোগকারী মুক্তিযোদ্ধারা এসব অপরাধে জড়িত রফিকুল ইসলাম ও কোটায় চাকরি পাওয়া তার কথিত সন্তানদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন।
এদিকে অভিযোগ পাওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে দুদক কর্মকর্তারা অনুসন্ধান শুরু করেন। সত্যতা পাওয়ায় দুদক বগুড়া কার্যালয়ে সহকারী পরিচালক জাহিদ হাসান গত ৩০ জানুয়ারি ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ রফিকুল ইসলাম ও তার তিন ভুয়া সন্তান বেলাল হোসেন, ফরহাদ হোসেন ও আহসান হাবিবের বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি মামলা করেন। মুক্তিযোদ্ধার সনদে চাকরি নিয়ে তার কথিত সন্তানরাও নানা দুর্নীতিতে জড়িয়ে লাখ লাখ টাকা সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।
এ প্রসঙ্গে ফরহাদ হোসেনের বাবা জাহিদুল ইসলাম দাবি করেন, জন্মের পর বীর মুক্তিযোদ্ধ রফিকুল ইসলাম তার ছেলেকে দত্তক নেন। লেখাপড়া ও লালনপালন করে বড় করেন এবং তাকে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সরকারি চাকরি পেতে সহযোগিতা করেছেন। এতে দোষের কিছু নেই।
অভিযোগ প্রসঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বলেন, তার দুটি মেয়ে রয়েছে। এরপরও তিনি দুই ভাতিজা বেলাল হোসেন ও ফরহাদ হোসেন এবং ভাগ্নে আহসান হাবিবকে সন্তান হিসেবে লালন-পালন করেছেন। তিনি তাদের মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরির ব্যবস্থা করেছেন। অন্য আর কাউকে কোটায় চাকরি বা অন্য সুযোগসুবিধা দেননি। কাউকে কলেজে ভর্তিতে সহযোগিতা করেননি। কিছু মানুষ তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। তিনি দুদকের ওইসব মামলা আদালতে মোকাবিলা করবেন বলে জানান।
দুদক বগুড়া কার্যালয়ের উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম অন্যের সন্তানকে নিজের সন্তান সাজিয়ে কোটায় চাকরি দিয়েছেন। অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় মুক্তিযোদ্ধা ও তিন কথিত সন্তানের বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি মামলা হয়েছে। অন্য অভিযোগের ব্যাপারেও তদন্ত চলছে।
সম্পাদক ও প্রকাশক মুজাহিদুল ইসলাম জাবের
𝐌𝐨𝐛𝐢𝐥𝐞: 𝟎𝟏𝟔𝟒𝟕𝟐𝟓𝟕𝟎𝟔𝟏